রোহিঙ্গা বিস্ময় বালিকা!


উখিয়ার বালুখালি-০১ ক্যাম্পের একটু ভেতরে ঢুকলে বাজারের আগেই চোখে পড়বে ফ্রেন্ডশিপ ক্লিনিক। প্রাথমিক স্বাস্থসেবা নিতে আসা রোহিঙ্গাদের লম্বা লাইন এই সকাল বেলাতেই। ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল দু’জন মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট পাশাপাশি ঘরে স্বাস্থসেবা দিয়ে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। হঠাৎ চোখ আটকে গেল ছয় থেকে সাত বছরের এক মেয়ের দিকে। নিজেই ডেকে লাইন থেকে পরবর্তী রোগী ডেকে নিয়ে আসছেন। মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট বা প্যারামেডিক এর কোন কথা রোগী বুঝতে না পারলে ঝরঝরে বার্মিজ ভাষায় বুঝিয়ে দিচ্ছে। আর রোগীদের কথা বুঝিয়ে দিচ্ছে ভাঙা ভাঙা বাংলায়। তবে তাতে মূল কথাটি বোঝা যাচ্ছে স্পষ্টভাবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল রোহিঙ্গা এই মেয়েটির নাম সাদিয়া। দিন পাঁচেক আগে প্রথম এসেছিল মাকে নিয়ে। এরপর সময় পেলেই নিজে নিজে চলে আসে ফ্রেন্ডশিপ ক্লিনিকে। ফ্রেন্ডশিপ ক্লিনিক, বালুখালি ক্যাম্প -০১
ফ্রেন্ডশিপ ক্লিনিক, বালুখালি ক্যাম্প -০১ এর মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট বিপাশা খাতুন বললেন, ‘ক্লিনিকের পাশেই ওর বাসা। খেলতে খেলতেই চলে আসে। প্রথমবার মাকে নিয়ে আসার পর, প্রায়ই ঘুরতে ঘুরতে ক্লিনিকের ভেতর চলে আসত। আমরাও আদর করতাম। এভাবে আসতে আসতে আমাদের কাজের ধরণ ও অনেকটাই বুঝে ফেলে। রোগী এলে প্রথমেই নাম, কোন ব্লক, রোগের বিবরণ ইত্যাদি জিজ্ঞেস করতে হয়। অনেক সময়ই দেখা যায় আমাদের কথা ওরা বোঝে না বা ওদের কথা আমরা বুঝছি না। তখন সাদিয়া নিজে থেকেই সেগুলো রোগীদেরকে বুঝিয়ে দিচ্ছে। আবার রোগীদের কথা আমাদেরকে ভাঙা ভাঙা বাংলায় বুঝিয়ে দিচ্ছে। এ কারণে চিকিৎসা পেতে রোহিঙ্গাদের খুব উপকার হচ্ছে।’

মায়ানমারে বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। সেখানেই ক্লাস টু পর্যন্ত পড়েছে সাদিয়া। বাংলাদেশে এসে বালুখালির একটি এনজিও স্কুলে চারদিন গিয়েছে। এরপর আর যাওয়া হচ্ছে না। কারণ স্কুলে জায়গার সঙ্কট। তবে পরের ব্যাচে সে আবার স্কুলে যাওয়া শুরু করবে। এই চারদিনে তিনটি বাংলা কবিতাও শিখে ফেলেছে বলে জানাল সাদিয়া। আমরা কবিতা শুনতে চাই। প্রথমে একটু লজ্জা পেলেও শুরু করলে সাদিয়া, ‘বাক বাকুম পায়রা, মাথায় দিয়ে টায়রা, বউ সাজবে কালকি, চরবে সোনার পালকি।’ আবার ধরে,‘ঝড় এলো এলো ঝড়, আম পড় আম পড়/ কাঁচা আম পাকা আম/টক ঝাল মিষ্টি /এই যা এলো বুঝি বৃষ্টি।’ চমৎকার আবৃত্তি নয় হয়ত। কিন্তু মাত্র চারদিনে এতাকিছু শিখে ফেলেছে ভাবতেই বিস্ময় জাগে।
পরিবারের কথা জিজ্ঞেস করতেই ভাইয়ের কথা বলে ওঠে। নাম তার মোহাম্মদ জাবের। ‘মায়ানমার আর্মি যখন উঠানে জাবেরকে ধরে ফেলে, আমরা তখন বাড়ির পেছন দিয়ে পালিয়ে চলে আসি। দূর থেকে দেখতে পাই ভাইয়ের বুকে ২টি গুলি করা হল।’ এসব দেখে কাঁদতে ভুলে যায় সাদিয়া। সে আরো বলে, ‘এরপর টানা চারদিন পায়ে হেঁটে নৌকায় উঠি। তারও দুইদিন পর বাংলাদেশে। বাবা মোহান্মদ জাকারিয়া, মা আর বৃদ্ধা দাদীকে নিয়ে কোনমতে প্রাণে বাঁচে সাদিয়ার পুরো পরিবার। অবাক হয়ে দেখি, মূলত দোভাষী হিসেবে কাজ করলেও এক মুহূর্ত বসে নেই সাদিয়া। প্রচণ্ড স্বত:স্ফুর্ত হয়ে সবাইকে সাহায্য করছে। এতোটুকু ক্লান্তি নেই। প্যারামেডিক যদি কারও জ্বর দেখার জন্য রোগীর মাথায় হাত দিয়েছেন, সঙ্গে সঙ্গে সে থার্মোমিটার এগিয়ে দিচ্ছে সাদিয়া। এতোটাই ভাল বুঝে গেছে ক্লিনিকের সবকিছু। একদম বড়দের মত রোগীদের দেখভাল করছে। ঔষধ কখন কীভাবে খাবে সেটা বুঝিয়ে দিচ্ছে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কীভাবে থাকতে হবে সেটা বুঝিয়ে দিচ্ছে। তবে এর মাঝেও চঞ্চলতা দেখা যায়। পাশেই ওদের বাসা হওয়ায় যখন তখন চলে যাচ্ছে আবার আসছে ইচ্ছে মতন।
পাশেই সাদিয়াদের ঘর। ভাবলাম একটু ঘুরে যাই। বেরিয়ে এলেন সাদিয়ার মা। বললেন, ‘সাদিয়া মানুষের উপকার করছে এতে আমার খুবই ভাল লাগছে। বাংলাদেশের সবাই আমাদেরকে এতো সাহায্য করছে, এখন যদি নিজেরা এটুকু সাহায্য করতে না পারি তাহলে কীভাবে হবে! আর ফ্রেন্ডশিপের সবাই এতো ভাল যে ক্লিনিকে যাওয়া আসার মাঝে থাকলে মেয়েটা ভাল কিছুই শিখবে বলে আমার বিশ্বাস।’ কথা হল সেবা নিতে আসা আযাই বেগম এর সঙ্গে। বাংলা একবিন্দু বোঝেন না। কথা বলতে হল সাদিয়ার সাহায্য নিয়েই। তিনি বললেন, ‘আমি এর আগেও এসেছিলাম ফ্রেন্ডশিপ ক্লিনিকে। তবে এবার এসে সবকিছু অনেক সহজ মনে হচ্ছে। কারণ সাদিয়া সবকিছু বুঝিয়ে দিচ্ছে। আল্লাহ ওর অনেক ভাল করুক। খুব অল্প সময়ে সবার শুভকামনা ও দোয়া পেয়েছে সাদিয়া। জিজ্ঞেস করি, বড় হয়ে কী হতে চাও? ‘বড় হয়ে একসময় আব্বুর মত স্কুলে পড়াতে চাই।’ এভাবেই নতুন দিনের স্বপ্ন দেখে এই ছোট্ট বিস্ময় বালিকা।

Post a Comment

[blogger]

MKRdezign

Contact Form

Name

Email *

Message *

Powered by Blogger.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget